জাতীয় সংসদে আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বিকেল ৩টায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয় ঘটিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি।
বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে। মোট ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এ খাতে। এটি মোট বাজেটের ৭.৪ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে আগামী বাজেটে নতুন করে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এবং বিভাগীয় শহরের বাইরে হাসপাতাল-ক্লিনিক নির্মাণে বিনিয়োগ করলে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হতে পারে। ২০৩১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ মিলবে। পাশাপাশি সরকারি সব হাসপাতালকে অত্যাধুনিক করা হবে। আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ করোনা মোকাবেলার পর্যাপ্ত সামগ্রী কেনা হবে। এ ছাড়া নতুন দুই হাজার চিকিৎসক, দুই হাজার নার্স এবং ৭৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। তাঁদের জন্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় বিশেষ বরাদ্দ : চলতি অর্থবছর করোনা মোকাবেলা, বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কেনা বাবদ সরকার ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। করোনা এখনো চোখ-রাঙাচ্ছে। তাই আগামী বাজেটেও পৃথক ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ থাকছে।
করপোরেট করে ছাড় আসছে : করোনার সময় ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে করপোরেট করে ছাড় দিতে পারে সরকার। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কম্পানির করপোরেট করহার ৩০ শতাংশ করা হতে পারে। এটি এখন সাড়ে ৩২ শতাংশ। সম্প্রতি কম্পানি আইন সংশোধন করে এক ব্যক্তির নামে কম্পানি খোলার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এ ধরনের কম্পানির করহার ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানির করহারও কিছুটা কমানো হতে পারে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে : অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, যত দিন কালো টাকা থাকবে, তত দিন সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে। তাই আগামী অর্থবছরেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। তবে তা ঢালাওভাবে থাকবে না। এলাকা-আয়তন ভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে কালো টাকায় ফ্ল্যাট বা ভবন কেনার সুযোগ থাকতে পারে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে নগদ বা ব্যাংকে রাখা টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ছে : বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ছে। তবে ভাতা বাড়বে না সব কয়টি খাতে। বাজেটে এ খাতে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭.৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে প্রথমবারের মতো দেশের ১৫০টি উপজেলার সব বয়স্ক মানুষ ও বিধবা নারীকে ভাতা দেওয়া হবে। এই ১৫০ উপজেলার প্রত্যেক বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাকেও ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বেড়ে ২৪ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়াবে। বাজেটে নতুন করে ১৮ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, প্রায় আট লাখ দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রায় তিন লাখ ল্যাকটেটিং (সন্তানকে দুধ খাওয়ানো) মা ভাতা পাওয়ার জন্য অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া বাজেটে হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৯৫ হাজারে উন্নীত করা হবে। নতুন বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার পরিমাণ ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
কর রেয়াত যেসব খাতে : করোনা সম্পর্কিত যাবতীয় চিকিৎসাসামগ্রীর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার বিদ্যমান থাকবে। হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর আমদানিতে কর রেয়াতও বিদ্যমান থাকছে। এসব সামগ্রী দেশে উৎপাদকদের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়াও বজায় রাখা হচ্ছে।
কর অবকাশের আওতা বাড়ছে : উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে আগামী বাজেটে নতুন করে কর অবকাশের সুবিধায় আসছে পাঁচটি খাত। এগুলো হলো কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ উৎপাদন, দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও খামার যন্ত্রপাতি উৎপাদন। এসব খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে, তারা আগামী ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা পাবে। এ ক্ষেত্রে ১০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কর মওকুফ সুবিধা পাবেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে ২৬টি শিল্প খাত কর অবকাশ সুবিধা পায়। এসব খাতের উদ্যোক্তারা ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে বিনিয়োগ করলে ১০ বছর পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা পাবেন। এবার এসি, ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিনের মতো গৃহস্থালির কাজে লাগে এমন ইলেকট্রনিকস পণ্যও কর অবকাশের সুবিধায় আনা হতে পারে।
বাজেটে ব্যয় ও আয় : বাজেট আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার বা ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার বাড়ছে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন করেছে।
বাজেটে অনুদান ব্যতীত ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬.২ শতাংশ। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬.১ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট .ৎসিড়ভ.মড়া.নফ-এ বাজেটের সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবে এবং দেশ বা বিদেশ থেকে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে। প্রাপ্ত সব মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময়ে ও পরে তা কার্যকর করা হবে।